২০২৩ সাল চলছে। অনলাইন বিশেষ করে ফেইসবুক কেন্দ্রিক দাওয়াত, ২০১৩ এর শাপলার কুরবানিসহ আরও অনেক কুরবানি, ইসলামিক বইয়ের বসন্ত ইত্যাদি নানা মাধ্যমে দাওয়াতী কাজের বিনিময়ে বিগত দশকে (২০১০+) বাংলাদেশের ইসলামপন্থী তরুণদের মাঝে নবজাগরণ এসেছে আলহামদুলিল্লাহ। পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইসলাম বিদ্বেষ। সমাজের মেরুকরণ সুস্পষ্ট হচ্ছে। আমি যতোদূর জেনেছি আশির দশকে বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে একটি ইসলামি জাগরণের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এইযে বিগত দশকে তরুণ কিশোরদের মাঝে যে ইসলামি জাগরণের সূচনা হয়েছে, দলে দলে পথহারা পথিকেরা নীড়ে ফিরে আসছে এই বিশাল তরুণ প্রাণদের তাদের নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা কী? তারুণ্যের শক্তিকে ইসলামের খেদমতে ব্যবহার করার জন্য আমাদের আদৌ কি কোনো পরিকল্পনা আছে? বর্তমানে তারুণ্যের এই শক্তিকে আমরা যা করছি সেগুলো বিশ্লেষণ করা যাক-
১। বই এর পাঠক হিসেবে। তাঁদের কাছে আমরা বই বিক্রি করছি।
২। অনলাইন বিভিন্ন কোর্স বিক্রি করছি
৩। তাদের জন্য বিভিন্ন অনলাইন বা অফলাইন একাডেমী খুলে পাঠদান করছি।
৪। ভিডিও কন্টেন/গ্রাফিক্সের কাজে তাদের সাহায্য নিচ্ছি।
জাতির উন্নয়নের জন্য গ্রন্থপাঠের কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞান অর্জন করা অপরিহার্য। কিন্তু এই জ্ঞান অর্জনের শেষ কোথায়? সবার জন্যেই কি এই সবগুলো বিষয় জানা জরুরি? কোর্সগুলো কি একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সামনে রেখে বানানো হচ্ছে? নাকি বিচ্ছিন্ন টপিকে ছাড়া ছাড়া ভাবে বানানো হচ্ছে?
আমাদের প্রকাশনা শিল্প কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুদূরদর্শী পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় টপিকে বই এর সংখ্যা কম। প্রচারণা কম। অথচ গৌন বিষয়গুলো নিয়ে বইয়ের সীমা পরিসীমা নেই। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয় যে বিগত দশকের শুরুর সময়ে তরুণদের মৌলিক আকীদার জ্ঞান বর্তমান সময়ের তরুণ যুবকদের চাইতে অনেক ভালো ছিল। সে সময় ইসলামি বই পত্র বা কন্টেন্ট এতো সহজলভ্য ছিলো না। এছাড়া উপরের ৪ টি পয়েন্ট কেন্দ্রিক দাওয়াতী কার্যক্রমের ফলে তরুণদের মধ্যে সেলিব্রেটি আলেম লেখক ইত্যাদি হবার ফেতনা দেখা দিচ্ছে।
সবচেয়ে আশংকার কথা হলো দ্বীনে ফেরা তরুণরা হতাশ হয়ে যাচ্ছে। বইয়ের গ্রুপগুলো দেখবেন আর আগের মতো সরগরম নেই। সেই একই ধাঁচের বই, একই রকম কন্টেন্ট । কোনো নতুনত্ব নেই। আর কতো! তরুণরা বই লেখতে পারছে না, সেলিব্রেটি হতে পারছে না,সবাই আলেম হতে চাচ্ছে জেনারেল পড়াশোনা ছেড়ে কিন্তু বাসায় মানছে না। আবার সবার মানসিকতা বিশেষ করে ছেলেদের মানসিকতা এমন না যে শুধু পড়াশোনা,লেখালেখির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে সন্তুষ্ট থাকবে। মাঠে দৌড়ঝাপের কিছু করার না পেয়ে, ক্রমাগত ইসলাম বিদ্বেষে নিশ্চুপ, নীরব ভূমিকা দেখে তারা বিরক্ত হয়ে যায়। হতাশ হয়ে যায়। হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। অনলাইন দাওয়াহ পিরামিডের চূড়া থেকে নেমে পতনের দিকে যাচ্ছে। দাওয়ার ফলাফল স্যাচুরেটেড হয়ে গেছে।
এলগরিদম, সমমনা/ঘরণা ছাড়া অন্যদের ফ্রেন্ডলিস্টে না রাখা ইত্যাদি নানা কারণে ইসলাম থেকে বেখবর জনগোষ্ঠীর কাছে আমাদের দাওয়াত পৌছানো সম্ভব হচ্ছে না। বিগত দশকের শুরুর দিকের যে দাওয়ার প্রভাব তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল- অনলাইনে একদল তরুণ দাঈর আবির্ভাব হলো। যারা এমনভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করছে যা অনলাইনে থাকা অন্যান্য সাধারণ তরুণ যুবকেরা দেখেনি। আগে এমন ভাষায় ইসলামের কথা শোনেনি। এই তরুণ যুবকদের ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ছিল। কিন্তু নানা কারণে ইসলাম পালন করতে পারেনি। অনলাইনের সেই তরুণ দাঈরা এই তরুণ যুবক ভাইদের কাছে পৌছাতে পেরেছিলেন। যেটা আমরা এখন পারছি না। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দাওয়াতি কার্যক্রমকে বেগবান ও তরুণ যুবকদের মধ্যে ইসলামি নবজাগরের ধারা বহমান রাখার জন্য নিচের ৩ টি বিষয় বিবেচনা করা যায় –
১। আমাদের অফলাইনে নামতে হবে। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে ইসলামিক বই পত্র ভিডিও কন্টেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশাল খেদমত হয়েছে বিগত দশকে। কিন্তু আমাদের হুজুর ঘরণার (যা মোট জনগোষ্ঠীর ১-২% হবে হয়ত) বাইরের বিশাল জনগোষ্ঠীর এই বইপত্র, ভিডিও এসব ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। তাদেরকে এসব ব্যাপারে অবগত করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ ইসলামের জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে আছে। তরুণ প্রজন্ম হতাশ, ঘরে ঘরে অশান্তি বিচ্ছেদ, মানুষ আত্মহত্যা করছে। মানুষ সমাধান খুজছে। সমাধান আমরা আমাদের হুজুর ঘরণার মধ্যে আটকে রেখেছি। তাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছি না। অফলাইনে দাওয়াতি কার্যক্রম, ক্যাম্পেইন, লিফলেট বিতরণ, সভা সেমিনার, ওয়ার্কশপ পোস্টারিং, জেলা উপজেলা পর্যায়ে বইমেলার আয়োজন, সমাজ সেবামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা ইত্যাদি নানাভাবে পরিচালনা করা যেতে পারে।
২। তারুন্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের শুধু বই পড়ানো, কোর্স করানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, অনলাইনে ঘরের কোণে বসিয়ে না রেখে সূর্যের আলোতে ময়দানে নিয়ে আসতে হবে। দাওয়াতি ও সমাজসেবামূলক কর্মকান্ডে যুক্ত করতে হবে। এতে তাদের মধ্যে দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, ইসলামের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেবে। সমাজের জন্য কল্যাণকর ভূমিকা রাখতে পারবে। দায়িত্ব নেওয়া, কমিউনিকেশন, আদব কেতা শিখবে। নেতৃত্বগুন বিকশিত হবে। দাওয়াত ও সমাজসেবার ছোটো ছোটো ফলাচলও নিজের চোখে দেখলে বা উপলব্ধি করলে তা তাদেরকে বহুগুনে অনুপ্রাণিত করবে।
৩। সম্মিলিত ও সুদূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে ফেইসবুক,ইউটিউবের দাওয়াতি কার্যক্রম, কোর্স, বই এর কন্টেন্ট বছাই করতে হবে। না হলে তরুণেরা বই ও ঈল্ম বিমুখ হয়ে যাবে। মোটাদাগে এই হলো আমার প্রস্তাবনা। আমার প্রস্তাবনা মানতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। সমালোচনা করুন, নতুন পয়েন্ট বা বাস্তবায়ন করা সম্ভব এমন প্রস্তাবনা এড করুন। কিন্তু একটাই অনুরোধ এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন।