ক.
আমাদের মসজিদগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছে। প্রাণহীন অন্তঃস্বারশূন্য। মসজিদের মাধ্যমে কতোকিছু করা সম্ভব হতো … কিন্তু এখন মসজিদে শুধু নামাজ পড়া আর এলাকার মুরুব্বীদের নেতৃত্ব নিয়ে রেষারেষির জায়গা হয়ে রয়েছে। আসমানের ওপর আর যমীনের নিচের ঘটনা ছাড়া কোনো কিছুই আর তেমন আলোচনায় আসে না মসজিদের খুতবাহতে। অথচ মসজিদ্গুলোকে ভালোমতো কাজে লাগাতে পারলে কতো কি করা যেত। যদি মসজিদের মিম্বার থেকে তরুণদের সমস্যা যেমন- প্রেম, জেনা ব্যভিচার, বিয়ে, আত্মহত্যা, হতাশা,বেকারত্ব ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হতো তাহলে তরুণদের জীবন কতোই না সহজ হতো। এমন আফসোস করতে দেখা যায় অনেককে। বিশেষ করে তরুণদের।
এর পাশাপাশি-
১। মসজিদের খুতবাহতে জীবনঘনিষ্ঠ কোনো বিষয়ে আলোচনা করার প্রস্তাব নিয়ে গেলে অনেক সময় খতীব সাহেব তাদের যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেন না এমন অভিযোগ করতে শোনা যায় তরুণ ভাইদের।
২। খতীব সাহেবারা অধিকাংশ সময় রাজি হন। কিন্তু মসজিদ কমিটির কারণে কিছু বলা যায় না।
মসজিদকেন্দ্রিক কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায় না- এমন অভিযোগ ১ নম্বর অভিযোগের চাইতেও বেশী শোনা যায়।
৩। এলাকার কোনো ভালো মানুষ মসজিদ কমিটিতে থাকেনা। সব সুদখোর, ঘুষখোর, মদখোর, জুয়াড়ী- এটিও অনেক শোনা যায়।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এই বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য। এগুলো আমাদের সমাজের চরম নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এখন আমরা দুইটি কাজ করতে পারি।
১। অভিযোগের ধারা জারি রাখতে পারি। মসজিদ কমিটি, খতীব সাহেবদের সমালোচনার পর সমালোচনা , চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে পারি।
২। বিদ্যমান বাস্তবতাকে পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করতে পারি। মসজিদগুলোকে আমরা সমাজ সংস্করণের হেড কোয়ার্টার বানাতে পারি।
১ নম্বর কাজ বছরের পর বছর করে গেলেও যে কোনো ইতিবাচক ফলাফল আসবে না তা মোটামুটিভাবে স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০ বছরে বিশেষ করে বিগত ১০ বছরে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। তবে ২ নম্বর পয়েন্টের কাজ যদি আমরা এখন শুরু করে দেই তাহলে ইনশা আল্লাহ ধীরে হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আজ যারা ২০ বছরের তরুণ আছো তোমাদের হাত ধরেই আগামী বছরগুলোতে বিপুল পরিমাণ সাফল্য আসবে ইনশা আল্লাহ।
খ.
সমস্যা সমাধানের আগে সমস্যা কেন তৈরি হচ্ছে এবং সমস্যার প্রকৃতি কি তা বোঝা জরুরি। মসজিদকেন্দ্রিক বিভিন্ন উদ্যোগে কেন তরুণরা মসজিদ কমিটি বা খতীবসাহেবদের মনোযোগ আকর্ষণ বা সাহায্য সহযোগিতা লাভে অনেক সময় ব্যর্থ হয়?
প্রথমেই আসবে মসজিদ কমিটির সমস্যা। মসজিদ পরিচালনা করার জন্য অধিকাংশ মসজিদ কমিটির যোগ্যতা নেই। তবে এই সমস্যার সমাধান আমরা চাইলেও করতে পারব না। তাই আমাদের নজর দিতে হবে আমাদের নিজেদের কি কি সমস্যা আছে তার উপর।
মসজিদ কমিটি বা খতীব সাহেবদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো না। সম্পর্ক ভালোনা বলতে আমাদের চেনেই না। হুট করে আমরা একদিন গিয়ে বলি, ‘ হুজুর, পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃত করছে, সমকামিতা প্রচার করছে। এসব নিয়ে কিছু বলেন।
বর্তমান পরিস্থিতি এবং মসজিদ কমিটির কথা বিবেচনা করলে টপিক গুরুত্বপূর্ণ , আলোচনা করা জরুরি- এটি বুঝতে পারলেও, একদল অপরিচিত ইয়ং পোলাপানের এমন আবদার মেনে নিতে অনেক খতীব সাহেবই প্রস্তুত নন। তারা মসজিদ কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেন।
মসজিদ কমিটিতে যারা আছে তারা প্রথমত বিষয়ের গুরুত্বই বুঝতে পারে না। আর কেউ বুঝতে পারলেও এই অপরিচিত পোলাপানকে নানা সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। ওরা অমুক দল না তো, ওরা এটা নাতো, ওরা সেটা না তো।
অনুমতি বা সাহায্য সহযোগিতা আর পাওয়া যায় না। মসজিদ কমিটির সঙ্গে আমাদের তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়। খতীব সাহেব সম্পর্কেও আমরা বিভিন্ন মন্তব্য করে বসি।
তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম- খতীব সাহেব এবং মসজিদ কমিটির সাথে আমাদের সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাঁদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এই আস্থা অর্জন, সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এগুলো একদিনে হবে না। সময় লাগবে।
মসজিদকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মসূচী – যেমন সকালের মক্তব পরিচালনা করা, মসজিদ কেন্দ্রিক লাইব্রেরি পরিচালনা করা, এলাকার শিশু কিশোরদের নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা,দাওয়াতি কর্মকান্ড পরিচালনা করা – এগুলো যে মসজিদ আবাদের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই বুঝ অধিকাংশ মসজিদ কমিটির কাছে নেই। তাদের কাছে মসজিদ আবাদ মানে মসজিদকে রাজপ্রাসাদের মতো করে সাজানো, এসি লাগানো, টাইলস লাগানো ইত্যাদি। তাই শুরুতেই মসজিদকেন্দ্রিক এমন কর্মসূচী হাতে নিলে তাঁদের আস্থা অর্জন করা দূরে থাক বরং সন্দেহের তালিকায় পড়তে হবে।
তাহলে কীভাবে তাঁদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যায়? আমি মোটামুটি যা দেখেছি নিজের অভিজ্ঞতায়, অন্যদের কাছে শুনে এবং একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে-
১। মসজিদের বিশাল অঙ্কের টাকা দান করার সামর্থ্য আমাদের তরুণদের নেই। যদি কারও থেকে থাকে তাহলে ১/২ বার মসজিদের ফান্ডে টাকা দিতে হবে। বাবা/মামা/চাচা এমন নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে বা অন্য যে কারও কাছ থেকে ফান্ড ম্যানেজ করে দিতে পারলে মসজিদে আপনার মোটামুটি এক্সেস পাওয়া শুরু হবে।
২। টাকা দিতে না পারলেও সমস্যা নেই। মসজিদের ছোটোছোটো কাজে শামিল থাকুন। যেমন-
i. মাঝে মাঝে মসজিদ ঝাড়ু দেন
ii. ওযুখানা, টয়লেট, মসজিদের উঠান ইত্যাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে সাহায্য করুন।
iii. দুই ঈদের আগে এলাকার সব পোলাপান নিয়ে পুরো মসজিদ এবং ঈদগাহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা। উৎসবের মতো করে
iv. মসজিদের আঙ্গিনায় ফল ও ফুলের গাছ লাগান। নিয়মিত সেগুলোর পরিচর্যা করা। এখন বর্ষাকাল চলছে। মসজিদের উঠানে কিছু ফলের গাছ লাগান। পেপে, পেয়ারা, আম, কাঠাল, ডাব টাইপের গাছ। একটা পেপে গাছের চারার দাম ৩/৪ টাকা। ৫০ টাকার পেপে গাছের চারা কিনলে কমপক্ষে ১০ টা পেপে গাছ লাগাতে পারবেন। ভার্সিটিয়ান দ্বীনি পরিবার এর পক্ষ থেকে বৃক্ষরোপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেখলাম।
v. মসজিদের জন্য বিভিন্ন দুয়া ক্যালেন্ডার, চিরস্থায়ী নামাজের সময়সূচীর ক্যালেন্ডার ইত্যাদি কিনে নিয়ে যান।
vi. খতীবসাহেবদের কাছে মাঝে মাঝে যান। বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করুন। নাসীহা চান। খতীব সাহেব অল্প বয়স্ক হলে এবং বিকেলে খেলাধুলার সুযোগ থাকলে সুযোগ কাজে লাগান।
vii. মসজিদের বাইরে আপনাদের বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক প্রোগ্রামে মসজিদ কমিটির তুলনামূলক বুঝদার সদস্য, খতীবসাহেবদের দাওয়াত করুন।
এভাবে কিছুদিন (কয়েকমাস বা ১/২ বছর) লেগে থাকলে ইনশা আল্লাহ মসজিদ কমিটি বা খতীব সাহেবদের নিকট আপনাদের গ্রহণযোগ্যতা, আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে ইনশা। মসজিদকেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়ে ইসলাম প্রচারের কাজকে বেগবান করতে পারবেন ইনশা আল্লাহ। একটু বয়স বাড়লে মসজিদ কমিটির সদস্য হবারও সুযোগ আসবে। এবং মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যায় যায় আগামী ১০/১৫ বছর পর আপনি মসজিদ কমিটির বেশ প্রভাবশালী একটি জায়গায় বসবেন ইনশা আল্লাহ।
নিছক ফ্যান্টাসি, অস্থিরতা,ত্বরাপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে আসুন একটু দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা করি। হক ও বাতিলের লড়াই চিরন্তন। এ লড়াই কখনো শেষ হয়ে যাবে না। ভূপ্রকৃতি,আন্তর্জাতিক, স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক অবস্থা,প্রতিবেশী দেশসমূহ সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আসুন সামাজিক শক্তি অর্জনের কর্মসূচী হাতে নেই।