এক.
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত একজন শাইখ আছেন – জহির মাহমুদ। বেশ আবেগ (পজিটিভ অর্থে) নিয়ে বয়ান করেন। লেকচার শোনার সেই স্বর্ণযুগটাতে অনেক শোনা হতো। উনি এক লেকচারে বলছেন- একবার আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু মদীনায় এক খেজুর গাছে উঠতে লাগলেন। তিনি বেশ শুকনো, পাতলা গড়নের ছিলেন। পা খুব সরু ছিল। তার সরু সরু পা দেখে কিছু সাহাবী হাসতে শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদের হাসতে নিষেধ করে বললেন- এই পা যদি মিজানে ওজন করা হয়, তাহলে উহুদ পাহাড়ের চাইতেও তা বেশী ভারী হবে’।
রাসূলুল্লাহ ﷺ কেন এমন বললেন? কারণ, এই পায়ের মাঝে যে রক্ত প্রবাহিত হয় তাঁর প্রতিটি ফোটা তাওহীদের সাক্ষী দেয়। কালেমার সাক্ষী দেয়। খালিদ, উমার, আলী (রাদিয়াল্লাহু আযমাইন) ইত্যাদি সাহাবীদের অধিক আলোচনার কারণে আমাদের মাঝে এমন ধারণা আছে যে সব সাহাবীরাই মনে হয় উমার, খালিদ বা আলীর মতো সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। এটা একটা ভুল ধারণা। সাহাবীদের মধ্যে যেমন যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আলী, খালিদের মতো সুঠাম দেহের মানুষ ছিলেন, তেমনি আবু বকর, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের মতো পাতলা গড়নের মানুষ ছিলেন। মুসাব বিন উমায়ের রাদিয়াল্লাহুর মতো যেমন সুদর্শন সাহাবী ছিলেন, তেমন সমাজের স্ট্যান্ডার্ডে দেখতে একটু অসুন্দর সাহাবীও ছিলেন।
আব্দুর রহমান ইবনে আউফদের মতো যেমন ধনী সাহাবী ছিলেন, তেমনি আসহাবে সুফফার নিঃস্ব সাহাবী ছিলেন যারা কাপড়ের অভাবে অতিকষ্টে সতর ঢাকতেন। মুয়াজ ইবনে জাবাল, উবাই বিন কাবের মতো যেমন আলেম সাহাবী ছিলেন, তেমনি বেদুইনদের মধ্য থেকে অনেক সাহাবী ছিলেন যারা মৌলিক বিষয়াদি বাদে অন্যান্য খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিস্তারিত জানতেন না। যেমন খালিদ আলী যুবাইর এর মতো যেমন প্র্যাক্টিক্যাল চিন্তা ভাবনার যোদ্ধা সাহাবী ছিলেন, তেমন হাসসান বিন সাবিত এর মতো ভাবুক, কবি সাহাবী ছিলেন। অনেকে ব্যবসায়ী ছিলেন, কেউ দিন মজুর ছিলেন, কেউ কৃষিকাজ করতেন। রাদিয়াল্লাহু আযমাইন। অর্থাৎ সমাজে বৈচিত্র্য ছিল। সবাই একই রকম ছিলেন না।
দুই.
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে রাসুল ﷺ বলেছেন, কিয়ামতের সবার আগে যাদের বিচারের জন্য আনা হবে— তারা হলো একজন দানবীর, একজন আলেম ও আল্লাহর পথে জি১হা২দ৩কারী একজন শহীদ। এদেরকে আল্লাহ জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন কারণ তাঁরা আল্লাহর জন্য নয়, বরং মানুষের প্রশংসা, খ্যাতি সম্মানের আশায় আমল করেছিল। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৮২)
বিখ্যাত এই হাদিস কমবেশী সবারই জানা। নিয়্যতের গুরুত্ব বোঝানোর ক্ষেত্রে এই হাদীস অতুলনীয়। তবে এই হাদীস থেকে অন্য একটি বিষয়েরও ইঙ্গিত পায়। বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তীতুল্য আলেম শায়খ আবদুল্লাহ আযযাম রহিমাহুল্লাহ যেমনটি তাঁর আল্লাহর প্রতি সততা গ্রন্থে আলোচনা করেছেন- সমাজ পরিচালনার জন্য আলেম, সম্পদশালী দানবীর ও শহীদ এই তিন শ্রেণীর মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কারণে এই তিন শ্রেণীর মানুষের প্রথমে বিচার করা হবে। এই হাদীস থেকেও আমরা সমাজে বৈচিত্রতার গুরুত্ব উপলব্ধি করি।
তিন.
প্রথম দুইটি অনুচ্ছেদে যে আলোচনা করা হলো তার উপর ভিত্তি করে এবার আলোচনার মূল অংশে প্রবেশ করা যাক। বিগত এক দশকের বাংলাদেশের ইসলামপন্থী তরুণদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা আলহামদুলিল্লাহ আমাদের হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণের আলোকে বর্তমান সময়ের ইসলামপন্থী তরুণদের মাঝে যে কয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় চলে এসেছে তা হলো –
১। সবাই লেখক হতে চাচ্ছে।
২। সবাই ক্রিটিক্যাল থিংকার বা চিন্তক হতে চাচ্ছে।
৩। অনেক সময় ঢালাওভাবে আলেম হবার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।
আরও কিছু বিষয় রয়েছে তবে আজকে এই ৩ টি বিষয় নিয়েই সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
সবার লেখক হতে চাইবার ফলে –
ক। ফেইসবুক অনেকটা মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। আগে ফেইসবুকের কথা মাথায় রেখে পোস্ট লেখা হতো। সেই পোস্টগুলো থেকে পূর্ণ মেসেজ পাওয়া যেত। অন্তর পরিবর্তন হতো। এখন বইয়ের কথা মাথায় রেখে পোস্ট লেখা হয়। পূর্ণ মেসেজ আসে না। অনেকেই ফেইসবুকে লেখা সময়ের অপচয় মনে করেন। এর ফলে উপকৃত হবার মাত্রা অনেক কমে গিয়েছে।
খ। সেলিব্রেটি লেখক হবার বাসনা রিয়া জন্ম দিচ্ছে। ইসলামের খেদমত নয়, বরং নিজের নফসের খেদমত করা মূল উদ্দ্যেশ্য হয়ে দাড়াচ্ছে। অশ্রদ্ধা, ঈর্ষা, গীবত, অপ্রয়োজনীয় মতপার্থক্য ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে- যা এড়ানো সম্ভব হতো।
গ। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন- ইমেজ, ভিডিও এডিটিং,পেইজ ম্যানেজমেন্ট, মাঠ পর্যায়ে দাওয়াহ করা, গ্রুপে কাজ করা এই বিষয়গুলো এখনকার অনেক তরুণদের কাছে গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে। বই লেখার নেশায় গুরুত্বপূর্ণ এই কাজগুলো করার সময় পাওয়া যাচ্ছে না।
ঘ। ঢালাওভাবে বই বাজারে আসছে। অধিকাংশ মানুষ অনুকরণপ্রিয় । তাই বইয়ের টপিকে কোনো বৈচিত্র আসছে না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বই আসছে না। পাঠকেরা ইতিমধ্যেই বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে।
সবাই ক্রিটিক্যাল থিংকার বা চিন্তক হতে চাইবার ফলে-
ক। ইসলামের মৌলিক বিষয় – ঈমান আমল সাহাবীদের জীবনী ইত্যাদির পরিবর্তে দর্শন, পাশ্চাত্যবাদ, নাস্তিকদের যুক্তি খন্ডন এসবের দিকে সবার মনোযোগ চলে গিয়েছে। অনেকের ঈমান আমল ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
খ। সবাই মিলে চিন্তা করছে। কিন্তু কাজ করার লোক নেই। আগে যারা কাজ করত, ট্রেন্ডে ভেসে এখন তারাও চিন্তক হওয়া শুরু করছে।
পাশ্চাত্যবাদ ইত্যাদি নিয়ে লেখালেখি বা চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে সমাজের অল্পকিছু যোগ্য মানুষ এ কাজে নিয়োজিত হওয়াই যথেষ্ঠ। বাকীদের প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু রেখে সেগুলো ছড়িয়ে দিলেই চলে।
সবার আলেম হতে চাইবার ফলে-
বাংলাদেশে আলহামদুলিল্লাহ অনেক আলেম রয়েছেন। জেনারেল লাইনের একজন ভাই নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলে আর একজন আলেম বৃদ্ধি পাবে। তবে এই ভাই একেবারে আলেম না হয়ে আলেমদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় বেসিক ঈল্ম অর্জনের পর তার জাহেল ফ্রেন্ড সার্কেল বা পরিচিতদের মাঝে দাওয়াতের কাজ শুরু করতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি এমন কিছু মানুষদের কাছে ইসলামকে প্রেজেন্ট করতে পারবেন যাদের কাছে আলেম মানে হলো ব্যাকডেইটেড, ক্ষ্যাত, মূর্খ। এ ধরণের মানুষদের কাছে আলেমদের পৌছানো অসম্ভব। দুঃখজনক হলেও এটা বাস্তবতা। তো এভাবে ইসলামের দাওয়াহ আরও গতিশীল হতে পারে। নতুন নতুন অনেক মাত্রা আসতে পারে। পাকিস্তানের ইয়ুথ ক্লাব যেমন বহুমাত্রিক দাওয়াহ করছে জেনারেলদের মাঝে তেমন করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সবার আলেম হওয়া যদি জরুরি হতো তাহলে সাহাবীরা জ্ঞানের কেন্দ্র মদীনা ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন ময়দানে ঝাপিয়ে পড়তেন না। দেখুন কোনো কাজকেই ছোটো ভাববেন না। আল্লাহ সবাইকে সমান যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেন নি। আপনি যদি ইমেজ বানানো, ভিডিও এডিটিং, পেইজের ইনবক্স সামলানো, পোস্ট আপলোড করার মতো কাজ করেন, তাহলে অন্য একজন ভাই (যাকে আল্লাহ যোগ্যতা দিয়েছেন) তিনি উপকারী বই লেখতে পারবেন।
আপনি যদি যোগ্য চিন্তক ব্যক্তিদের অনুসরণ করে ইসলামের কথা মানুষের কাছে নিয়ে না যান, যদি মাঠ পর্যায়ে কাজ না করেন, যদি কর্মী বা সংগঠকের ভূমিকা না নেন তাহলে চিন্তকের চিন্তা বইয়ের পাতাতেই আবদ্ধ থাকবে। সেগুলো মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সমাজ পরিবর্তনের রোডম্যাপ আপনার সামনে আছে। প্রয়োজনীয় চিন্তক সমাজে উপস্থিত। এমন অবস্থায় আপনার চিন্তক হওয়ার কোনো দরকার আছে ইসলামের জন্য? সমাজ পরিবর্তনের জন্য ১০০ জন লেখক বা ১০০ জন চিন্তকের পরিবর্তে ৫ জন লেখক ও ৯৫ জন সংগঠক/ কর্মী/দাঈ বেশী প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সময় থেকে নিয়ে শুরু করে প্রতিটি যুগেই প্রতিটি সমাজেই ইসলাম বা অন্য যেকোনো মতাদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে লেখক বা চিন্তকদের সংখ্যা ছিল কম। মাঠ পর্যায়ের কর্মী, সংগঠক দাঈদের সংখ্যা ছিল বেশী। তারা একেবারে ময়দানে থেকে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে। লেখক বা চিন্তকদের চাইতেও ইতিহাস পরিবর্তনে মূখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। এটাই আসলে আল্লাহর সুন্নাহ। ২+২ = ৪ হওয়া, পানির পিপাসা মেটানোর ক্ষমতা, সূর্যের পূর্ব থেকে উদয় আর পশ্চিম দিকে অস্ত হয়ে যাওয়া … ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিয়মের মতো এটাও একটি প্রাকৃতিক নিয়ম।
চার.
কোনো কাজই ছোটো নয়। সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্বাচিত হাদীসটি স্মরণ রাখুন: “তাকে পাহারায় নিয়োজিত করলে পাহারায় থাকে আর (দলের) পেছনে পেছনে রাখলে পেছনেই থাকে” (সহিহ বুখারী-২৮৮৭)
অর্থাৎ যেখানেই তাকে দায়িত্ব দেয়া হোক, তিনি তা পালন করে যান এবং এগিয়ে যান। তিনি যদি সৈন্যদের পিছনে থাকেন তবে পিছনে থেকেই দায়িত্ব পালন করেন। আর যদি তিনি পাহারার দায়িত্ব পান তবে তিনি সে কাজও আঞ্জাম দেন। কারণ তাঁর উদ্দেশ্য হল ‘পুরষ্কার’ চাই তাঁকে যেখানেই রাখা হোক না কেন!।
খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথা চিন্তা করুন। উনার কাছ থেকে সেনাপতির পদ নিয়ে অন্য এক সাহাবীকে দেওয়া হলো। উনি সংগে সংগে তা মেনে নিয়ে সাধারণ একজন সৈনিকের কাতারে নেমে আসলেন। কোনো প্রতিবাদ নয়, কোনো বিদ্রোহ নয়, কোনো কিছু নয়। কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন- আল্লাহ পদ মর্যাদা, সম্মান খ্যাতি প্রভাব প্রতিপত্তি দেখেন না। আল্লাহ দেখেন অন্তরের ইখলাস। দেখুন আপনি কি কাজ করেছেন সেটার চাইতে আপনার অন্তরের অবস্থা কেমন ছিল, নিয়্যত কি ছিল, ইখলাস কেমন ছিল এসবের উপর ভিত্তি করে বিচার হবে। তাই কোনো কোনো দরিদ্র সাহাবী এক টুকরো খেজুর দান করেও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রশংসা পেয়েছেন। আবার কোনো কোনো দানশীল ব্যক্তি প্রচুর দান করেও জাহান্নামে যাবে।
কাজের পরিমাণ, কাজের প্রকৃতি এসব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপনার নিয়্যত। মানুষের প্রশংসা, মনোযোগ,আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা, ক্ষমতা কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার কাজের ইখলাস। মানুষ জানলো কি জানলো না, মানুষ আপনাকে চিনলো কি চিনলো না, আপনার সাথে সেলফি তোলার আবদার করলো কি করলো না, কোনো মজলিশে আপনাকে আদর করে, সম্মান করে সামনে বসালো কিনা, আপনার হাজার হাজার ফ্যান ফলোয়ারস থাকলো কিনা- এসব একেইবারেই গুরুত্বহীন জিনিস। আমার আপনার মূল মনোযোগ দেওয়া উচিত- আমি যে কাজটা করছি তা আল্লাহর জন্য করছি কিনা। আমার এই কাজের মাধ্যমে আল্লাহ খুশি হবেন না অসন্তুষ্ট হবেন। কাজেই আমার মন কি চাইছে সেটা করার পরিবর্তে ইসলামের জন্য কি করা জরুরি – সেই কাজটা করাই অধিক তাকওয়ার ।