আবার চলে এলো ইংরেজি নববর্ষ- হ্যাপি নিউ ইয়ার! হ্যাপি নিউ ইয়ার শুনেই বন্ধুদের সাথে সারারাত ঘোরাফেরা, আউলা ঝাউলা গান ছেড়ে উদ্দাম নাচানাচি, খাওয়া দাওয়া, পাগলাপানি, আতশবাজি, ফানুশ, ট্যুর, গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের বিশেষ আবদার পূরণ… এগুলোর কথা মাথায় ঘুরছে তোমার, তাই না? মৌজ মাস্তি আর রঙ্গিন আতশবাজিতে মুখর এক আকাশের দৃশ্য ভাসছে তোমার চোখের সামনে, তাই না? এসো এই আকাশের বাইরে অন্য এক আকাশ দেখবে তুমি।
চার বছরের ছোট্ট তানজীম। সেদিন রাতেও তানজীম মনের আনন্দে খেলছিলো। রাত তখন প্রায় পৌনে বারোটা। হঠাৎ শহরজুড়ে শুরু হলো আতশবাজি আর পটকার বিকট শব্দ। হাসিখুশী তানজীমের চেহারা বদলে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। প্রতিটা বিকট আওয়াজে প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠছিলো ওর দেহ। কাঁদতে কাঁদতে গলা শুকিয়ে গেলো ওর। আতঙ্কে চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসছিলো গর্ত থেকে। শ্বাসকষ্ট শুরু হলো।
কোনোমতে রাতটা কাটিয়ে ভোরে ভোরেই তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। বিকেলে ডাক্তার বললেন, হার্টফেল করে ছোট্ট তানজীম উমায়ের আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে। [জাগো নিউজ,৩.১.২২]
শুধু তানজীম নয় এমন সংবাদ অনেক শোনা যায়।
নববর্ষের আতশবাজি ও ফানুশের আগুনে…
১। রোমে পুড়ে মরল শত শত পাখি [যুগান্তর ২.১.২১]
২। ইউরোপে শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু, আহত শতশত [সময় সংবাদ, ২.১.২২]
৩। পুড়ে ছাই পুরান ঢাকার অনেক দোকান, সর্বশান্ত ব্যবসায়ীরা [প্রথম আলো, ১.১.২২]
নববর্ষ উদযাপনের সময়…
১। শাংহাই-এ পদদলিত হয়ে ৩৬ জনের মৃত্যু [বিবিসি, ১.১.১৫]
২। মিলানে অসংখ্য নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার, হয়েছে অসংখ্য ডাকাতি [বিবিসি, ১.১.১৬]
৩। ভারতের ব্যাংগালুরে শতো শতো নারী যৌন নির্যাতনের শিকার [গার্ডিয়ান, ৪.১.১৭]
৪। জয়পুরে ধর্ষণের শিকার ১৭ বছরের তরুণী [টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৬.১.২২]
থার্টি ফাস্ট নাইটের উন্মাদনায় বন্ধুদের সাথে মিলে তুমি পটকা আতশবাজি ফোটাচ্ছো, ফানুশ উড়াচ্ছো, আকাশ রঙিন করে দেওয়া এ আনন্দকে তুমি নিছক বিনোদন ভাবছো, কিন্তু একটাবারও কি ভেবেছো ছোট্ট উমায়েরদের কথা? মন ভোলানো কন্ঠের পাখিগুলোর কথা? তোমার দাদা-দাদুর কথা কিংবা ঘরের ছোট্ট ভাইটার কথা? অসংখ্য অসুস্থ মানুষ, নারীদের চোখের জল ও অনেক লাশের উপর দিয়ে হলেও এসব করে যেতে হবে ? একে কি তোমার নিছক বিনোদন মনে হয় ভাই?
থার্টি ফাস্ট নাইট, আতশবাজির মত সংস্কৃতি যারা চুপি চুপি এসে আমাদের দিয়ে গেলো, চোখ বন্ধ করে যে পশ্চিমাদের মত হয়ে উঠতে চাইছি আমরা, তুমি কি জানো না তারা কী করেছে আমাদের সাথে? আমরাই ছিলাম বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ধনী দেশ, আমরাই ছিলাম অভিজাত।
ঢাকা ছিল রূপকথার রাজকীয় এক নগরী। আমাদের ছিল মসলিন, আমাদের ছিল মসলা, ছিল সিল্ক, পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু। আমাদের তৈরি করা জাহাজ ভেসে বেড়াতো এক মহাসমুদ্র থেকে অন্য মহা সমুদ্রে। এরপর সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসলো ওরা, ফিরিঙ্গিরা। ওদের শোষণ, অত্যাচার আর লুটপাটে ধ্বংস হলো সোনার বাংলা। পরিকল্পিতভাবে ওরা নিয়ে আসলো দুর্ভিক্ষ। মারা গেলো কোটি কোটি মানুষ।
যারা সোনার বাংলাকে শ্মশান বানালো, যারা বাহাদুর শাহ পার্ক আর গ্রান্ড ট্রাংক রোডের প্রত্যেকটা গাছে আমাদের পূর্বপুরুষদের ফাঁসিতে ঝোলালো তাদের অনুকরণে, তাদের অনুষ্ঠান পালন করে তাদের মতে হতে চাইতে তোমার লজ্জা করে না? পশ্চিমা লুটেরাদের হাত থেকে এ ভূখন্ডকে মুক্ত করার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই তিতুমীর, হাজী শরীয়তউল্লাহ, সাইয়্যেদ আহমেদ শহীদদের অশ্রু, ঘাম আর রক্তের সাথে গাদ্দারি করতে তোমার একটুও বুক কাপে না? কোথায় তোমার আত্মসম্মান? আত্মমর্যাদা?
তুমি পশ্চিমা লুটেরাদের উৎসবের উন্মাদনায় মাতাল হয়ে নাচছো, দু হাতে টাকা উড়াচ্ছো, অন্যদিকে ফুটপাতে শীতে ঠকঠক করে কাপছে হাজার হাজার পথশিশু। রংপুর, গাইবান্ধা কিংবা পঞ্চগড়ের কোনো অসহায় বৃদ্ধা! ক্ষুধায় এপাশ ওপাশ করে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে বেকার যুবকের দল।
তোমার এসব চোখে পড়ে না? তুমি তরুণ, তুমি জাতির মেরুদ্বন্ড। সত্য ও ন্যায়ের জন্য এ ভূখন্ডের তরুণেরা বুকের রক্ত ঢেলে দিতে দ্বিধাবোধ করেনি, আর সেই তুমিই এসব অসহায় মানুষের আর্তনাদ উপেক্ষা করে দুহাতে টাকা অপচয় করে যাচ্ছো? কিভাবে তোমার গলা দিয়ে লাল নীল পানি নিচে নামো? এতোটাই স্বার্থপর হয়ে গিয়েছ তুমি?
তুমি রাসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসার কথা বলো। সেই তুমিই আজ কেন রাসূল (ﷺ) এর নিষেধ অমান্য করছ? তিনি কি মদীনায় এসে মুসলিমদের জন্য উৎসবের দিন হিসেবে কেবল দুই ঈদকে নির্ধারণ করে দেননি?[সুনান আবু দাউদ] তিনি কি বলেননি যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদের দলভুক্ত”[সুনান আবু দাউদ-৪০৩১]
তুমি কি জানোনো নিউ ইয়ার পালন করা বিধর্মীদের উৎসব? কেন তুমি খৃস্টান আর পৌত্তলিকদের উতসব পালন করছ, মদ খাচ্ছ, গান বাজাচ্ছ, বাজি পুড়াচ্ছ, যিনা করছ, ডুব দিচ্ছ অশ্লীলতায়? কেন এমন প্রতারণা করছ? চিরকাল কি তুমি বেঁচে থাকবে? তুমি মরবে না? কেমন হাশর হবে তোমার? আল্লাহর সামনে কিভাবে দাঁড়াবে?
আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (ﷺ) আমাদের নিষেধ করেছেন বিধর্মীদের অনুকরণ করতে, নববর্ষ পালন করতে। অন্যদিকে সেলিব্রেটি আর মিডিয়া নববর্ষ উদযাপন করতে উৎসাহ দিচ্ছে। নিজেকে প্রশ্ন করো ভাই, প্রশ্ন করো বোন, তুমি কার কথা শুনছো? কার দাসত্ব করছো? কার সুন্নতের অনুসরণ করছো? কাকে খোদা হিসেবে মেনে নিয়েছ?
‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ না বললে তোমার নতুন বছর মন্দ যাবে এমন না। তাহলে পাশ্চাত্যে এতো অশান্তি থাকতো না। ভালো রাখার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ কারও বিন্দুমাত্র ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না। [মুসনাদ আহমাদ]
আমরা সেই আল্লাহকে অসন্তুষ্ট রেখে কিভাবে ভালো দিন কাটাবো? বাড়ি গাড়ি টাকা পয়সা, আলোকজ্জ্বল চাকচিক্যে ভরা জীবন মানেই ভালো থাকা নয়। পশ্চিমাদের এই চোখধাঁধানো জীবনের আড়ালে রয়েছে অন্য এক জীবন। রয়েছে হতাশা, অবসাদ, আত্মহত্যা, খুন ধর্ষণের বসত। ঘোরলাগা চোখে হয়ত আমরা তা দেখতে পাই না।
হতাশা, আত্মহত্যা…
১. সবচেয়ে হতাশাগ্রস্থ দেশের তালিকার ১ নম্বরে ইউক্রেন, ২ নম্বর আমেরিকা, ৪ নম্বর অস্ট্রেলিয়া [১]
২.আমেরিকায় ৫ জনে ১ জন আত্মহত্যা করার কথা ভাবছে
৩. প্রতি ৩ জন কানাডিয়ানের ১ জন ভয়াবহ মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন।
৪. অ্যামেরিকা ও কানাডার টিনেজারদের মৃত্যুর দুই নম্বর কারণই হচ্ছে সুইসাইড [২]
‘তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মানসিক সমস্যা ক্রমশ বেড়ে যাওয়ায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, আমাদের সমাজ এক মহা সঙ্কটের ভেতর পড়েছে’!
– ড. জন ক্লিনটন, শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি
ধর্ষণ…
১. প্রতি ৬৮ সেকেন্ডে আমেরিকায় ১ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে [৩]
২. প্রতি ৩ জনের ১ জন শিক্ষার্থী যৌন নির্যাতনের শিকার হয় অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে [৪]
ভয়ঙ্কর একাকীত্ব…
১. জার্মানির প্রতি ৪ জন বৃদ্ধ নাগরিকের ১ জন মাসে মাত্র একবার অন্য মানুষের সাক্ষাত পায়, অনেকে তাও পায় না
২. আমেরিকায় প্রতি ৩ জন বৃদ্ধের ১ জন একাকী বসবাস করে
৩. অধিকাংশই মারা যায় বৃদ্ধাশ্রমে বা একাকী ফ্ল্যাটে [৫]
ইসলামে মজা করা, বিনোদন নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু সেটা হতে হবে হালাল ভাবে। আমাদের দুইটি ঈদ আছে, আল্লাহ আমাদের ঈদ উদযাপন করতে বলে দিয়েছেন। ইসলাম সেসব বিষয়কেই নিষিদ্ধ করেছে যা ব্যক্তি, পরিবার সমাজ সবার জন্যই ক্ষতিকর। আর এই নিউ ইয়ার উপলক্ষে কত কত ক্ষতি হচ্ছে, আশা করি তা একটু হলেও তুমি বুঝতে পেরেছ।
প্রিয় ভাই ও বোন, তোমরাই সমাজ ও জাতির মূল চালিকা শক্তি। যুগে যুগে কালে কালে যখন সমাজের অসুখ করে, যখন নিকষ কালো আঁধারে ছেয়ে যায় চারপাশ তখন আলোর মশাল হাতে পথ চলে তরুণেরাই। আজ তোমরাই যদি সত্য,সুন্দর মহান সব কিছুকে গুঁড়িয়ে দিয়ে অন্ধকার কানা গলির পথে যাত্রা করো তাহলে সমাজের কি হবে? অনেক তো আঁধারের পথে চললে, অনেক তো ভাঙলে এবার চলো গড়বে …
নববর্ষের বিধ্বংসী আনন্দের পরিবর্তে …
১। শীত বস্ত্র বিতরণ করো
২।পথ শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করো
৩।এলাকার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করো
৪। মোবাইলে মুখ গুজে পড়ে থাকা ছোটো ভাইদের খেলার মাঠে নিয়ে যাও
৫। অভাবী মানুষদের সাবলম্বী করার ব্যবস্থা করো
৬। বন্ধুদের নিয়ে পাঠচক্র গড়ে তোলো
তারুণ্যের এই শক্তিকে হেলায় নষ্ট করো না। নষ্ট কষ্টে কাটিয়ে দিও না মাটির পৃথিবীর এই জীবন। অমিত সম্ভাবনাময় তোমার জীবন ভাই। মনে রেখ তারুণ্যের শক্তিকে কিভাবে ব্যয় করেছ সেই প্রশ্নের উত্তর একদিন দিতে হবে তোমাকে… হাশরের ময়দানে!