প্রশংসা করার ব্যাপারে আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে সামনাসামনি প্রশংসা করার ক্ষেত্রে। ফেইসবুকে প্রশংসা করাও সামনা সামানি প্রশংসা করার মধ্যে পড়ে। কারণ যার প্রশংসা করা হচ্ছে সেও তো এসব দেখছে বা জানছে। আমাদের দেশের বড় বড় আলেম উলামা গুনীজন তাদের সামর্থ্য সম্ভাবনা অনুসারে কাজ করতে না পারার অন্যতম একটা বড় কারণ হলো আমরা তাদের মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করি। তাদের নামের আগে বড় বড় লকব টানাই। এগুলো তাদের ব্যাপক ক্ষতি করে। রিয়া অহংকার, আত্মতৃপ্তি, আত্মতুষ্টি, স্থবিরতা নিয়ে আসে। ওয়াজ মাহফিলে বা কোনো সভা সেমিনার বা কোনো মজলিশে আলেম উলামা বা কাউকে পরিচিত করিয়ে দেবার জন্য বাতিলের আতঙ্ক, আশার প্রদীপ,উম্মাহর সিংহ এমন ১০/১২ টা লকব না লাগাই। শুধু বলি আজকে আমাদের সামনে উপস্থিতি আছেন সম্মানিত আলেম … বা বলতে পারেন আমাদের সামনে উপস্থিত আছেন লেখক সম্পাদক …এভাবে।
কোনো হকপন্থী আলেম বা এক্টিভিস্টদের মানুষের কাছে পরিচিত করিয়ে দেবার জন্য তাদের লেখা বা বক্তব্যের প্রশংসা করার দরকার পড়তে পারে। এর ফলে সাধারণ মানুষ তাদের গুরুত্ব বুঝে গ্রহণ করে নেবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও তাদের লেখা বা বক্তব্যের সামনাসামনি প্রশংসা যেভাবে করা যাবে না- ভাইয়ের কথা যেন আগুন, ভাইয়ের চেহারা বেশ নুরানি মাশা আল্লাহ্ আর কন্ঠটাও কতো সুন্দর, ভাইয়ের লেখার হাত অসাধারণ, সেই অস্থির লেখছেন ভাই , ঈশ ভাই আপনার মতো যদি লেখতে পারতাম … এভাবে প্রশংসা করলে ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করা হয়। অথচ সেই ভাই বা আলেমের নিজের তো কোনো কৃতিত্ব নেই। সব কৃতিত্ব তো আল্লাহ্র। এভাবে প্রশংসা করা যেতে পারে বা পোস্ট/ভিডিও শেয়ার করার সময় ক্যাপশনে লেখা যেতে পারে- এই ভিডিওটি শুনুন। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। এই লেখায় অমুক সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়েছে, পড়ুন শেয়ার করুন। আশাকরি মূল থিমটা ধরতে পেরেছেন। ঠিক একইভাবে আমাদের যদি কেউ প্রশংসা করে তাহলে তাদের সংশোধন করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা মানুষের প্রশংসা পাবার জন্য কাজ করি না। আমরা কাজ করি আল্লাহর জন্য।
সামনাসামনি প্রশংসা দ্বারা অহমিকা সৃষ্টি হয়। এমন প্রশংসাকে হাদিসে ধ্বংসের কারণ আখ্যায়িত করা হয়েছে। আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তির প্রশংসা করতে শুনে বলেন, ‘তোমরা তাকে ধ্বংস করে দিলে বা তোমরা তার মেরুদণ্ড ভেঙে ফেললে।’ (বুখারি, হাদিস : ২৬৬৩)
একজন মুসলিম ভাইয়ের উচিত অন্য মুসলিম ভাইয়ের ব্যাপারে সুধারণা রাখা। একজন ভাইয়ের ব্যাপারে অভিযোগ শুনেছিলাম তিনি অমুক ভাইকে সম্মান করেন না। অথচ সেই অভিযুক্ত ভাইয়ের বক্তব্য ছিল এমন – ভাই উনি যদি আমাকে বলেন যে ১ হাজার বার কান ধরে উঠবস করতে হবে আমি তাই করব কোনো প্রশ্ন ছাড়া।
এক্টিভিজমের সময় সব ভাইয়ের সঙ্গে সবার মতামত মিলবে না। সবাইকে সবার পছন্দ হবে না। সুধারণা রাখতে হবে একে অপরের প্রতি। উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনতে হবে। আর যেটা প্রধান বিবেচ্য বিষয় হবে- যে ভাইয়ের সাথে আমার মত মিলছে না তিনি কি শরীয়ার গন্ডির ভেতরে আছেন না বাইরে।
খুব স্পষ্ট করেই বলি আমি নিজে আমার জ্ঞানত কাউকে হালাল উপার্জন করাকে নিরুৎসাহিত করা, সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে শুধু এক্টিভিজম করা বা পড়াশোনায় গুরুত্ব না নেওয়া-এমন উপদেশ দেইনি। বরং বিভিন্ন লেখায় এর উল্টোটা বলেছি। ইরফান সাদিককে এক পরীক্ষার আগের রাতে ফেইসবুকে দেখে প্রচন্ড মাত্রায় ঝাড়ি মেরেছিলাম। ও খুবই মন খারাপ করেছিল।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাইকে ফাঁকিবাজি, অলসতাকে দ্বীনি এক্টিভিজমের মোড়ক লাগিয়ে পড়াশোনা, ক্যারিয়ার বা পরিবারের দায়িত্ব না নিতে চাইবার জন্য অনেক কথা শুনিয়েছি।
রিযিকের মালিক আল্লাহ্। আমাদের কাজ চেষ্টা করে যাওয়া। সাধ্যের মধ্যে যতোটুকু চেষ্টা করা যায় সেখানে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে।
সেই সঙ্গে এই বিষয়ও স্পষ্ট করে বলে দেই- সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন কুরবানি করার মানসিকতা না রাখলে হবে না। আপনি সব কিছু ব্যালান্স করে, সব কিছু ঠিকঠাক রেখে একদম আরামসে সমাজ পরিবর্তন করতে পারবেন না। আপনাকে স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। হোক সেটা ক্যারিয়ার, হোক সেটা নিজের ফ্রি সময়, সামাজিক মর্যাদা, অর্থ, পরিবার… কিছু না কিছু স্যাক্রিফাইস করতেই হবে।
এটাই ইসলামের চিরন্তন সুন্নাহ।
কুরবানি করার মানসিকতা না থাকলে, সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে সময় নষ্ট করার দরকার নেই।
আমাদের সবাই ব্যবসা করে , ক্যারিয়ার বানিয়ে টাকা কামাতে হবে। কেন?
কারণ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচুর টাকা লাগবে।
টাকা যে লাগবে এটাতে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর কাছে কি আসলেই টাকা নেই? সব টাকা পয়সা কি কুফফারদের কাছে গচ্ছিত? ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য টাকা লাগবে তাই ক্যারিয়ার বানিয়ে ব্যবসা করে টাকা পয়সা কামাতে হবে-এমন দাবী করলে শুরুতেই এই প্রশ্ন তোলা দরকার ছিল।
বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ টি দেশের মধ্যে কাতার,আরব আমিরাত আছে। গালফ কান্ট্রিগুলোর তেল বেচা টাকার কোনো কুল কিনারা নাই। ২০২২ সালে প্রায় ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে। বাংলাদেশের রিজার্ভের প্রায় ১০ গুন টাকা শুধু এক ফুটবল টুর্নামেন্টের পেছনেই উড়িয়েছে। এই বিপুল টাকা কেন দ্বীনের খেদমতে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না,কিভাবে দ্বীনের খেদমতে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে প্রশ্ন করা, চিন্তা করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা এই প্রশ্নগুলো করিনা। ব্যাপক টাকা কামাইতে হবে ইসলামের খেদমত করার জন্য টাইপের দাবীগুলো আসলে কতোটুকু যৌক্তিক তা চিন্তা করে দেখিনা।