সেক্যুলার আধিপত্য ভাঙ্গা এবং ইসলামকে সামাজিক শক্তি হিসেবে হাজির করার জন্য অফলাইনের কাজ কেমন হতে পারে?
এই প্রশ্নের সম্ভাব্য কিছু উত্তর নিচে দেয়া হল।
উল্লেখ্য, এই তালিকা অসম্পূর্ণ এবং প্রাথমিক। এখানে সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ আছে।
ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে সচেতনতা/গবেষণা: বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামবিদ্বেষ নিয়ে কাজ করার জন্য “ক্লাব” বা “কেন্দ্র” তৈরি করা যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম একটা উদ্যোগ আগে থেকেই চলছে, সেটার অনুকরণে বা অন্য কোন ভাবে হতে পারে।
এধরণের প্ল্যাটফর্মের উদ্দেশ্য হবে কর্মক্ষেত্রে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং জনপরিসরে ঘটা ইসলামবিদ্বেষের ঘটনাগুলো নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা। সমাজে থাকা ইসলামবিদ্বেষের আদর্শিক শেকড় মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করা। ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। এবং সাধ্যমত ইসলামবিদ্বেষের শিকার মুসলিমদের; বিশেষ করে আমাদের বোনদের পাশে দাঁড়ানো।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: বাংলা সাহিত্যে ইসলামবিদ্বেষ, সংবাদ ও সাংবাদিকতায় ইসলামবিদ্বেষ, পপুলার মিডিয়াতে ইসলামবিদ্বেষ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামবিদ্বেষ, চাকরির নিয়োগে ইসলামবিদ্বেষ, “সুশীল সমাজের” বক্তব্যে ইসলামবিদ্বেষ – এই ধরণের বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করা যেতে পারে। পশ্চিমে এধরনের অনেক অ্যাকাডেমিক কাজ হয়েছে (বিশেষ করে ইহুদীবিদ্বেষ ও বর্ণবৈষম্য নিয়ে) সেগুলো থেকে আইডিয়া নেয়া যেতে পারে।
জরিপ, গবেষণা প্রতিবেদন, আলোচনা, স্টাডি সার্কেল, লিফলেটিং, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, ওয়েবিনার, সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন, প্রতিকী প্রতিবাদসহ বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি সাধ্যমত এখানে কাজে লাগানো যেতে পারে।
লিগ্যাল এইড: খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তব দুনিয়াতে কাজ করতে গেলে বাঁধাবিপত্তি আসবেই। অনেক ক্ষেত্রে হয়রানিমূলক গ্রেফতারি বা মামলার ভয় দেখানো হতে পারে। এছাড়া মিছিল থেকে গ্রেফতারের দৃষ্টান্তও আমরা দেখেছি। এসব ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা দেয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আইনজীবিদের সাথে যোগাযোগ, খরচ, সমন্বয় এই ধরণের বেশ কিছু কাজ এখানে থাকে। আলিমদের তত্ত্বাবধানে তরুণ আইনজীবি ভাইরা এধরনের উদ্যোগ নিতে পারেন।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বা কর্মক্ষেত্রে ইসলাম পালনের জন্য বৈষম্য ও প্রশাসনিক হয়রানির শিকার মুসলিমদের আইনী সহায়তা দেয়া।
ইসলামী ইতিহাস: বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলামী ইতিহাস নিয়ে আলোচনার জন্য ক্লাব/কেন্দ্র/সোসাইটি তৈরি হতে পারে।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: আলোচনা, স্টাডি সার্কেল, বই পড়া প্রতিযোগিতা, গবেষণামূলক প্রবন্ধ তৈরি, উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস, বাংলায় মুসলিম শাসন, আমাদের মুসলিম পরিচয়, বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও আন্দোলন নিয়ে আয়োজন (বালাকোট, ফরায়েজী, তিতুমীর, পাটনা আন্দোলন, দেওবন্দ আন্দোলন ইত্যাদি)।
পাশাপাশি ওয়ার্কশপ, সেমিনার, ওয়েবিনারসহ বিভিন্ন ধরণের পদ্ধতি সাধ্যমত এখানে কাজে লাগানো যেতে পারে। এধরণের ম্যাটেরিয়াল নিয়ে মুসলিম ইতিহাসভিত্তিক পডকাস্ট বা ইউটিউব ভিডিও-ও বানানো যেতে পারে। যদিও এটা অনলাইনের কাজ, তবে প্রাসঙ্গিক হওয়াতে উল্লেখ করা হল।
ইসলামী চিন্তা ও সভ্যতা: ইসলামী ইতিহাসের অনুরূপ। এখানে বিশেষভাবে সমাজ, সভ্যতা ও শাসন নিয়ে মুসলিম উলামা এবং চিন্তাবিদদের ধারনার ওপর ফোকাস করা যেতে পারে। আল-গাযযালি, ইবনু খালদুন, ইবনু তাইমিয়াহ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ, শাহ ইসমাইলসহ অতীত ও নিকটবর্তী অতীতের আরো অনেককে নিয়েই কাজ করা যেতে পারে। রাহিমাহুমুল্লাহ।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: ইসলামী ইতিহাসের অনুরূপ।
অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানে ইসলাম: এ ধরণের কেন্দ্র/ক্লাবের মাধ্যমে ইসলামের শিক্ষার আলোকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: আলোচনা, স্টাডি সার্কেল, গবেষণামূলক প্রবন্ধ তৈরি। ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রে আলোচনা হতে পারে সুদের ভয়াবহতা, ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাস্তবতা, আন্তর্জাতিক ঋণের বাস্তবতা, ওয়াকফ-সাদাকাহ-যাকাতের আর্থসামাজিক সম্ভাবনা, দারিদ্র্য বিমোচনে করযে হাসানা ভিত্তিক মাইক্রোফাইন্যান্সের সফলতা ও সম্ভাবনা, ফিনটেকের সাথে সমন্বয় করে মুশারাকা-মুদারাবাসহ সাদাকা ও ওয়াকফের প্রয়োগসহ নানা বিষয় নিয়ে।
মনোদৈহিক সমস্যার সমাধানে ইসলাম: ইসলামের আলোকে মনোবিজ্ঞান, আধুনিকতার তৈরি মানসিক সমস্যার সমাধানে তাযকিয়াতুন নাফস, তাসাউফ, কানা’ (সন্তুষ্টি), যুহুদ, মুসলিম আলিমদের চিন্তার আলোকে মানসিক সমস্যার কারণ ও সমাধান-কাজ হতে পারে এধরনের বিভিন্ন টপিকে।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: মনোদৈহিক ও সামাজিক বিষয়ের ক্ষেত্রে নিয়ে আল-গাযযালি, ইবনুল জাওযী, ইবনুল কাইয়্যিম, আবু যাইদ আল-বালখীসহ বিভিন্ন মুসলিম ব্যক্তিদের চিন্তা ও গবেষণা নিয়ে আয়োজন। উবুদিয়্যাহর ধারণা নিয়ে আলোচনা। ডিপ্রেশন-সুইসাইড-অবক্ষয়ের সমাধানে ইসলাম, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, ওয়েবিনার, বুকলেট তৈরি, ডেইলি প্ল্যানার তৈরি, রমাদ্বান ও যুল হিজ্জার ইবাদাত উপলক্ষে বিশেষ ওয়ার্কশপ ইত্যাদি।
পাশ্চাত্যবাদ: ইসলামের প্যারাডাইম থেকে মডার্নিটি এবং এর মতবাদগুলোর খণ্ডন। বিশেষ সেক্যুলার জমিদারদের বহুল ব্যবহৃত মতবাদগুলোর খণ্ডন। এ বিষয়ে আমি অন্যান্য জায়গাতে বেশ লেখালেখি করেছি, তাই এখানে আলাদাভাবে আনলাম না।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: বাছাই করা বই পড়া, গবেষণামূলক প্রবন্ধ, খণ্ডনমূলক প্রবন্ধ, শর্ট কোর্স, আলোচনা, ওয়ার্কশপ, ইউটিউব ভিডিও, পডক্যাস্ট ইত্যাদি।
সামাজিক অবক্ষয়ের মোকাবেলায় ইসলাম: এধরনের প্ল্যাটফর্মের অধীনে বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে কাজ করা যেতে পারে। যেমন – পর্নোগ্রাফি, যিনা/প্রেম, স্ক্রিন আসক্তি, পরিবারের ভাঙ্গন, মাদকাসক্তি ইত্যাদি।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: লিফলেটিং, আলোচনা, স্টাডি সার্কেল, স্ট্রিট দাওয়াহ, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, ওয়েবিনার, বিষয়ভিত্তিক বুকলেট ছাপানো, কিশোরতরুণদের নিয়ে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচী, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা আয়োজন (খেলা কিংবা অন্যান্য) ইত্যাদি। এধরণের ম্যাটেরিয়াল নিয়ে মুসলিম ইতিহাসভিত্তিক পডকাস্ট বা ইউটিউব ভিডিও-ও বানানো যেতে পারে। যদিও এটা অনলাইনের কাজ, তবে প্রাসঙ্গিক হওয়াতে উল্লেখ করা হল।
পড়াশুনা, ক্যারিয়ার এবং বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা যেহেতু বর্তমানের তরুণদের জন্য বড় একটা সমস্যা তাই ক্যারিয়ার অ্যাডভাইস এবং ম্যারিটাল কাউন্সেলিং নিয়েও কাজ করা যেতে পারে।
ইলম: প্রাথমিক ইলম অর্জন সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য ক্লাব/কেন্দ্র বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুরু করা যেতে পারে।
সম্ভাব্য কার্যক্রম: তাজউয়ীদ শিক্ষা, প্রাথমিক আকীদাহ (তাওহীদ, ঈমান, কুফর, শিরক, বিদআহ, আল ওয়ালা ওয়াল বারা, নাওয়াকিদুল ইসলাম), ফারযুল আইন মাসায়েল, শরীয়াহর অপরিহার্যতা, তাযকিয়াতুন নাফস, সীরাত শিক্ষা, প্রাথমিক তাফসীর, চল্লিশ হাদীস, দৈনন্দিন জীবনে সুন্নাহ পালন, উবুদিয়্যাহর ধারণা ও শিক্ষা, আরবী শিক্ষা, ইত্যাদি।
দাওয়াতী ও ইসলাহী প্ল্যাটফর্ম: ইসলামী অ্যাক্টিভিসম বলতে সাধারণত আমাদের দেশে এধরনের কাজকেই বোঝানো হয়, তাই এ নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলার প্রয়োজন নেই। ইসলাহী দাওয়াহর পাশাপাশি ওপরের অনেকগুলো কনসেপ্ট এই ধরণের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
এছাড়া শরীয়াহ শাসন এবং আমর বিল মা’রুফ ও নাহি আনিল মুনকারের বিষয়গুলো এধরণের প্ল্যাটফর্মে বিশেষভাবে গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ। দ্বন্দ্বমূলক (confrontational) মনোভাব, হুমকি-ধামকি, আলটিমেটাম ইত্যাদির বদলে নাসীহাহ, শিক্ষাদান, সতর্ক করার আদলে আলোচনা আসলেই উত্তম হবে।
পাশাপাশি ম্যাগাযিন ছাপানো, ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতা, ইসলামী কবিতা, সেমিনার ও ইস্যুভিত্তিক অন্যান্য আয়োজন হতে পারে। প্রফেশানালরাও (অর্থাৎ যারা ছাত্র জীবন পার হয়ে এসেছেন) তা বিভিন্নভাবে এ ধরণের অ্যাক্টিভিসমের যুক্ত হতে পারেন। যারা সক্রিভাবে যুক্ত হতে পারবেন না তারা নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে এবং ফান্ডিংসহ অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এধরনের উদ্যোগে অংশগ্রহণ করতে পারেন। চ্যারিটি এবং সমাজসেবামূলক বিষয়ে নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও সামর্থ্য অনুযায়ী উল্লিখিত বেশ কিছু ফরম্যাটের কাজ তাদের নিজের প্ল্যাটফর্মের যুক্ত করতে পারেন।
উল্লেখ্য এই কাজগুলো মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ না। অর্থাৎ কেউ একটা করলে অন্যগুলো করতে পারবে না, ব্যাপারটা এমন না। সুযোগ ও সামর্থ্য অনুযায়ী এক প্ল্যাটফর্মে উল্লিখিত একাধিক ধরণের কাজ হতে পারে।
***
সামাজিক শক্তি অনেক ধরনের সংজ্ঞা হয়। তার মধ্যে একটা দিয়ে শেষ করি। সংজ্ঞাটা একটু কাঠখোট্টা লাগবে, কিন্তু এটা আত্মস্থ করতে পারলে ইন শা আল্লাহ উপকার হবে।
সামাজিক শক্তি হল এমন সব ধরণের প্রভাব ও চাপপ্রয়োগের সক্ষমতার সমষ্টি যা (সমাজের) কোন এক গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর ওপর প্রয়োগ করে। এই শক্তি প্রয়োগ করা হয় অন্যদের আচরণকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে, অথবা সামষ্টিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সেই গোষ্ঠীর নিজস্ব কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে।
Gene Sharp, How Non-Violent Struggle Works